গতকাল বুধবার ‘৬ এপ্রিল’ দুপুরে এ ঘটনা ঘটে। পরে ছাত্রীরা স্কুল ছেড়ে বাড়িতে গিয়ে বিষয়টি তাদের অভিভাবকদের জানালে এলাকায় তোলপাড় শুরু হয়। এ ঘটনায় অভিভাবকেরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন।
এর জেরে কয়েকশ অভিভাবক বৃহস্পতিবার ‘৭ এপ্রিল’ দুপুরে ওই স্কুলে গিয়ে এ ঘটনার প্রতিবাদ জানান। এ সময় অভিযুক্ত শিক্ষিকাকে না পেয়ে তারা স্কুলের আসবাবপত্র ভাংচুর করেন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
নির্যাতনের শিকার ওই স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সাদিয়া আফরিন অভিযোগ করে বলেন, বুধবার দুপুরে জাতীয় সঙ্গীতের পর লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায় ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা আমোদিনী পাল কেন হিজাব পরে স্কুলে এসেছি জিজ্ঞাসা করেই ইউক্যালিপ্টাস গাছের ডাল দিয়ে পেটাতে থাকেন।
সাদিয়া বলেন, শিক্ষিকা তাদেরকে বলেন, স্কুলে কোনো পর্দা চলবে না। ঢং করে আসছ। বাসায় গিয়ে কি বোরকা পরে থাক? যখন তোমরা মহাদেবপুর বাজারে যাবে তখন পর্দা করবে। স্কুলে এলে মাথার কাপড় ফেলে আসবে।
তিনি ছাত্রীদের হিজাব খুলে ফেলার জন্য টানাটানি করেন। যারা হিজাব ছাড়া শুধু মাস্ক পরে এসেছিল তাদের মাস্কও খুলে দেন। তিনি হুমকি দেন যে, কাল থেকে যদি হিজাব ও মাস্ক পরে আসো তাহলে পিটিয়ে তোমাদের পিঠের চামড়া তুলে নেওয়া হবে।
শিক্ষার্থী সাদিয়া আরও জানায়, লাইনের কয়েকজন ছাত্রীকে মারতে মারতে তার কাছে এসে তাকে মারতে থাকলে লাঠি ভেঙে যায়। এছাড়াও দশম শ্রেণির ছাত্রী ঐশি, সুমাইয়া, তিথি, লাকি, নবম শ্রেণির মোনাসহ কমপক্ষে ২০ জন ছাত্রীকে পেটানো হয়।
সাদিয়ার মা সাবেরা বেগম জানান, তার মেয়ে স্কুল থেকে এসে কান্নাকাটি করে বলে যে, হিজাব পরার জন্য ম্যাডাম মেরেছেন।
তিনি বলেন, আমাদের মেয়েরা বড় হয়েছে। তারা তো পর্দা করবেই। স্কুলে গিয়েই ভদ্রতা শিখবে। তা না শিখিয়ে যদি এরকম মারপিট করে তাহলে আমাদের সন্তানদের নিরাপত্তা কোথায়?
এ সময় তিনি সন্তানদের নিরাপত্তার স্বার্থে অভিযুক্ত শিক্ষিকার অপসারণ দাবি করেন।
দশম শ্রেণির আরেক ছাত্রী উম্মে সুমাইয়া আকতারের মা মরিয়ম নেছাও জানান, তার মেয়ে সুমাইয়া ও ক্লাসমেট তিথি জাতীয় সঙ্গীতের পর স্কুলে গেলে তারা কেন হিজাব পরে স্কুলে গেছে সেই অপরাধে শিক্ষিকা আমোদিনি পাল তাদেরকে পিটানোর জন্য শিক্ষক বদিউল আলমকে নির্দেশ দেন।
নির্দেশ পেয়ে বাদিউল মাস্টার সুমাইয়া ও তিথিকে লাঠি দিয়ে পেটায়। এ ঘটনার পর তার মেয়ে ক্লাস না করে বাড়ি এসে কাঁদতে থাকে।
অভিভাবকরা জানান, বৃহস্পতিবার দুপুরে তারা স্কুল ঘেরাও করেন। কিন্তু অভিযুক্ত শিক্ষিকা এ দিন স্কুলে আসেননি।
প্রভাবশালী একটি মহল বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার তৎপরতা চালাচ্ছেন।
ওই শিক্ষিকার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনে ছাত্রীদের হেনস্থার প্রমাণ থাকলেও তার বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়ায় জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তারা অবিলম্বে অভিযুক্ত শিক্ষিকার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।
ঘটনার সত্যতা জানার জন্য অভিযুক্ত শিক্ষিকা আমোদিনি পালের মোবাইল ফোনে কল দিয়ে সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পর তিনি ফোন কেটে দেন।
পরে অনেক বার কল দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
অভিযুক্ত অপর শিক্ষক বদিউল আলম জানান, হিজাব না পরায় ছাত্রীদেরকে শিক্ষিকা আমোদিনি পাল মারধর করেছেন। তিনি নিজে কাউকে মারেননি বলেও দাবি করেন।
ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ধরণী কান্ত বর্মণ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, স্কুলে হিজাব পরে আসায় শিক্ষিকা আমোদিনি পাল ৫-৬ জন ছাত্রীকে মারধর করেছেন।
ঘটনার দিন তিনি স্কুলের কাজে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে গিয়েছিলেন। বৃহস্পতিবার সকালে স্কুলে এসে বিষয়টি জেনেছেন।
তবে বিকেলে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত অভিযুক্ত শিক্ষিকার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে শিক্ষিকাকে শোকজ করবেন বলে জানান প্রধান শিক্ষক।
এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশে দায়িত্বশীল আচরণের আহ্বান জানিয়ে মহাদেবপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ‘ওসি’ আজম উদ্দিন মাহমুদ বলেন, বিষয়টি খুবই সেনসেটিভ। এ বিষয়ে থানায় কোনো লিখিত অভিযোগ আসেনি।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার হাবিবুর রহমান হিজাব পরায় স্কুলছাত্রীদের পেটানোর কথা স্বীকার করে বলেন, আগে তাকে শোকজ করা হবে। তারপর তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জেলা শিক্ষা অফিসার মো. লুৎফর রহমান জানান, এ বিষয়ে তিনি অবগত নন। তবে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত হয়ে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।