খুলে গেলো বাঙালির শত সহস্র স্বপ্নের দুয়ার পদ্মা সেতু। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুক্ত হলো নতুন পালক। শনিবার (২৫ জুন) সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে এ সেতুর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই সেতু উদ্বোধনে শুধু পদ্মাপাড় নয়, সারাদেশে বিরাজ করছে উৎসবমুখর পরিবেশ। কেন্দ্রে সমালোচনা থাকলেও দেশের সর্বস্তরের মানুষ সঙ্গে এই উৎসবে শামিল বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজের শুরু থেকে এ বিষয়ে সমালোচকের অবস্থানে রয়েছে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। খোদ দলটির প্রধান খালেদা জিয়া ‘পদ্মা সেতু হবে না, ভেঙে পড়বে’ বলে উপহাসও করেছিলেন। যদিও শেষ পর্যন্ত পদ্মা সেতু নির্মিত হওয়ায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি বলেছেন, কোনো ব্যক্তি বা দলের টাকায় নয়, পদ্মা সেতু জনগণের টাকায় নির্মিত হয়েছে।
পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে সরকারের তরফ থেকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও তারা তাতে সায় দেয়নি।
দেশে একাধিকবার সরকার গঠন করা এ রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব পদ্মা সেতু ইস্যুতে এমন সমালোচনামূলক অবস্থানে থাকলেও এক্ষেত্রে উচ্ছ্বাস লুকোয়নি তাদের তৃণমূল।
পদ্মা সেতু নির্মাণ হওয়ায় সম্প্রতি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে খুলনা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এবং মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু ফেসবুকে লেখেন, ‘হারিয়ে যাবে আমাদের চিরচেনা পথের অনেক কিছু। স্মৃতিতে অম্লান হয়ে থাকবে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পদ্মা নদী পারাপারের মাওয়া-কাঁঠালবাড়ী ঘাট। উদ্বোধন হতে যাচ্ছে আগামী ২৫ জুন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের প্রত্যাশার পদ্মা ব্রিজ।’
পদ্মা সেতু নিয়ে অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে গোপালগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শরীফ রাফিকুজ্জামান ভেল্কি নিউজকে বলেন, পদ্মা সেতুর ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের শুধু একুশ জেলা নয়, এটা সমগ্র বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। যমুনা সেতুর যেমন সমগ্র দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে এটাও ঠিক তেমনি অবদান রাখবে। একটা দেশের উন্নতির জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন দরকার। সেদিক থেকে এটাকে আমি ইতিবাচকভাবে দেখি। তবে এই সেতুর নির্মাণব্যয় ও প্রক্রিয়া নিয়ে আমার দলের সমালোচনা রয়েছে, যার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত।
২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে মাদারীপুর থেকে ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী খলিলুর রহমান ঠানডু চৌধুরী বলেন, ‘২০০৪ সালে এ সেতু বাস্তবায়নের দাবিতে আমরা আন্দোলন গড়ে তুলি, আওয়ামী লীগ নেতা শাহজাহান খান, বরিশালে বিএনপির মুজিবুর রহমান সরোয়ার, জহির উদ্দিন খান স্বপন, শরীয়তপুরের প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাকসহ আমরা অনেকের সঙ্গে মিটিং করেছি। আমি শাহজাহান খানের প্রতি কৃতজ্ঞ। আমরা সবাই এই সেতুর জন্য আন্দোলন করেছি। তবে দুঃখের বিষয়, আমরা যখন এই সেতু নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলি তখন ১৫ হাজার মানুষকে আমি ভাত খাইয়েছি, আর এখন পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমি বিএনপি করার অপরাধে থাকতে পারলাম না।’
মাদারীপুরের শিবচর আসনে গত সংসদ নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী সাজ্জাদ হোসেন সিদ্দিকী লাভলু ভেল্কি নিউজকে বলেন, সেতুর ফলে পদ্মাপাড়ের মানুষ আমরা সবচেয়ে বেশি খুশি। দীর্ঘদিন যাবত লঞ্চ বলেন, ফেরি বলেন, স্পিডবোট বলেন কোনো ভদ্রলোক ভদ্রভাবে কখনো পার হতে পারেননি। সীমাহীন দুর্ভোগ যন্ত্রণা পোহাতে হয়েছে। আল্লাহ এখন আমাদের পদ্মা সেতুর মাধ্যমে সেই দুর্ভোগ কমানোর সুযোগ দিয়েছেন।
ধানের শীষ প্রতীকে শিবচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান প্রার্থী নাদিরা ইয়াসমিন বলেন, পদ্মা সেতু হয়ে আমাদের উপকার হয়েছে এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তবে এত বিশাল অর্থ খরচ করে এ ধরনের আয়োজন না করলে ভালো হতো, আরও কম করা যেত। তবে পদ্মা সেতু উদ্বোধন হয়েছে, এখন আমরা তাড়াতাড়ি যাওয়া-আসা করতে পারবো এজন্য প্রধানমন্ত্রী একটা ধন্যবাদ পান।
সরকার পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়ার পর ২০১৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর এক সমাবেশে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বক্তব্য ছিল এমন- ‘পদ্মা সেতু কি হচ্ছে? হচ্ছে না। এ সরকার পদ্মা সেতুও করতে পারলো না।’ ২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি আবারও একই ধরনের মন্তব্য করেন বিএনপি চেয়ারপারসন। তখন তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতু আওয়ামী লীগের আমলে আর হবে না। আর যদি সেতু জোড়াতালি দিয়ে বানায়, সেই সেতুতে কেউ উঠতে যাবেন না। অনেক রিস্ক আছে।’
সমালোচনায় পিছিয়ে ছিলেন না বিএনপির অন্য নেতারাও। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক অনুষ্ঠানে দাবি করেন, ‘টিকবে না পদ্মা সেতু।’ সম্প্রতিও সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘একটা ভ্রান্ত ও ভুল ডিজাইনের ওপরে পদ্মা সেতু নির্মিত হলে সেটা যে টিকবে না, সেটা তো উনি (খালেদা জিয়া) ভুল বলেননি। এটা সত্য প্রমাণিত হয়েছে যে, পদ্মা সেতু রং (ভুল) ডিজাইনের ওপরে নির্মিত হচ্ছে।’
গত ২৭ মে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আবদুস সালাম বলেন, ‘আজকের এই পদ্মা সেতুতে ওঠার আগে আমাদের চেক করে দেখতে হবে আবার বাঁশ দিয়েছেন কি না।’
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগ মুহূর্তে এখন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, পদ্মা সেতু জনগণের টাকায় হয়েছে, কারও পকেটের টাকায় হয়নি, তাই পদ্মা সেতু নিয়ে কারও একক কৃতিত্বের দাবি হাস্যকর।